আফিং-এর যুদ্ধে লিন্-সে-সুর ভূমিকা | Lin-se-sur's role in the opium war

 আফিং-এর যুদ্ধে লিন্-সে-সুর ভূমিকা | Lin-se-sur's role in the opium war 

আফিং-এর যুদ্ধে লিন্-সে-সুর ভূমিকা | Lin-se-sur's role in the opium war


প্রথম ইঙ্গ-চীন যুদ্ধ বা আফিং যুদ্ধের পিছনে লিন্-সে-সুর ভূমিকাকে অস্বীকার করা যাবে না। মাঞ্চু সরকার ১৮৩৮ সাল বেআইনি আফিং ব্যবসাকে বন্ধ করার জন্য মরিয়া প্রচেষ্টা চালায়। চীন সরকার লিন-সে-সু নামক এক দক্ষ অফিসারকে ক্যান্টনের কমিশনার নিয়োগ করলে ইঙ্গ-চীন সম্পর্ক এক নতুন মাত্রা পেয়েছিল। আফিং ব্যবসাকে কেন্দ্র করে চীনা রাজদরবার দুটি পরস্পরবিরোধী গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। একদল চেয়েছিল আফিং ব্যবসাকে আইনসিদ্ধ করা হোক। তাহলে চোরাপথে আফিং আমদানি যেমন বন্ধ হবে তেমনি অন্যদিকে সরকারের আয় বাড়বে। অন্য একদল নৈতিকতার দিক দিয়ে চালিত হয়ে এই ব্যবসাকে উৎখাত করতে চেয়েছিল। নৈতিকতার পতনকে অধিকাংশ চীনা বুদ্ধিজীবী মানতে পারেন নি। তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সরকার চীন থেকে বেআইনি আফিং ব্যবসা বন্ধ করার জন্য লিন্-সে-সুকে দায়িত্ব দিয়েছিল। সেই সময় একাজে লিনের থেকে অন্য কেউ দক্ষ ছিলেন না তা বলাই বাহুল্য।


লিন-সে-সু (১৭৮৫-১৮৫০) ছিলেন তৎকালীন চীনের এক বিশেষ শিক্ষিত ব্যক্তিত্ব। এই পণ্ডিত ব্যক্তি উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। সমসাময়িক ঘটনাবলি, পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার প্রতি তাঁর জ্ঞান ছিল। পাশ্চাত্য বণিকদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল ছিলেন। তিনি দায়িত্বশীল সরকারি কাজে নিযুক্ত ছিলেন। কিয়াংশুর গভর্নর বা হু কোয়াং-এর গভর্নর জেনারেল হিসাবে তিনি নিজ যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছিলেন। এই সৎ অকপট ব্যক্তিত্বকে চীনবাসী নীল আকাশের সঙ্গে তুলনা করেছিল। তার চরিত্র এবং ব্যক্তিত্ব ছিল নীল আকাশের মতো নির্মল ও পরিচ্ছন্ন। তাঁকে যে Lin the blue sky বলা হত তা ছিল সার্থক।

আফিং-এর যুদ্ধে লিন্-সে-সুর ভূমিকা | Lin-se-sur's role in the opium war


মাঞ্চু সরকার লিন কে বেআইনি আফিং ব্যবসা রদ করার দায়িত্ব দিয়ে ক্যান্টনের কমিশনার পদে পাঠান। ১৮৩৯ সালের ১০ মার্চ ৫৪ বছর বয়স্ক লিন কমিশনার হিসাবে ক্যান্টনে এসেছিলেন। তিনি আফিং ব্যবসা বন্ধ করার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণে মানসিক প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। যেসব চীনা বণিক এই অসৎ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাদের বিরুদ্ধে তিনি কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি উয়েহুয়া অ্যাকাডেমিতে প্রধান কার্যালয় স্থাপন করেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। বিদেশিরা বেআইনি আফিং ব্যবসা করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছে। এই ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়ার অর্থ বিদেশি তথা ইংল্যান্ডের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হওয়া এবং যুদ্ধের সম্ভাবনা তৈরি হওয়া প্রথম দিকে তিনি প্রত্যক্ষ সংগ্রামে জড়িত হতে চাননি। তিনিবিদেশিদের শক্তি সম্পর্কে বেশি সচেতন ছিলেন। তিনি প্রথম দিকে আফিং ব্যবসার ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে প্রচার চালিয়েছিলেন। তাতে কাজ হয়েছিল। এই ক্ষতিকারক ব্যবসার সঙ্গে যেসব চীনা বণিক জড়িত ছিলেন তিনি তাদের কঠোর শাস্তি দিয়েছিলেন। তিনি দেশি ও বিদেশি বণিকদের মজুত আফিং তার হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর আদেশ বিদেশি বণিকরা মানতে চায়নি। দেশের স্বার্থে তিনি বেআইনি আফিং ব্যবসাকে বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। তিনি এই সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন যে বিদেশিদের এই ব্যবসা তিনি বন্ধ করবেন। তিনি প্রয়োজনে বিদেশিদের সঙ্গে যুদ্ধের ঝুঁকি নিতেও রাজি ছিলেন। তিনি বিদেশিদের আদেশ দেন তাদের মজুত করা সমস্ত বেআইনি আফিং তাঁর হাতে তুলে দিতে হবে। ভবিষ্যতে বিদেশিরা এই ধরনের ব্যবসা করবে না এই অঙ্গীকার তাদের করতে হবে।

আফিং-এর যুদ্ধে লিন্-সে-সুর ভূমিকা | Lin-se-sur's role in the opium war


লিন-সে-সু বিদেশিদের সম্পর্কে সজাগ ছিলেন। তিনি বিদেশি সংবাদপত্র ও তাদের বিভিন্ন লেখাগুলোকে চীনা ভাষায় অনুবাদ করিয়েছিলেন। তিনি ড্যাট্রোল (Vattel)-এর রচিত আন্তর্জাতিক আইনের গ্রন্থগুলিকে চীনা ভাষায় অনুবাদ করিয়ে পড়েছিলেন। এইসব গ্রন্থগুলি পড়ার উদ্দেশ্যে ছিল কীভাবে চোরা কারবার বন্ধ করা যায় এবং এক্ষেত্রে কী পরিস্থিতিতে যুদ্ধ ঘোষণা করা যায় তার জটিল দিকগুলোকে অনুধাবন করা। তিনি সমগ্র পরিস্থিতিকে জানিয়ে ইংল্যান্ডের রানি ভিক্টোরিয়াকে দুটি পত্র পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু এই পত্রগুলি ইংল্যান্ডের রানির কাছে পৌঁছেছিল কিনা তাতে সন্দেহ আছে। তিনি দ্বিতীয় চিঠিতে ইংল্যান্ডের রানিকে লিখেছিলেন, অন্য দেশের লোকেরা যদি আপনার দেশে আফিং নিয়ে গিয়ে আপনার প্রজাদের আফিং-এর নেশায় অভ্যস্ত করে তোলে আপনি নিশ্চয় তাদের ঘৃণা করবেন, প্রতিবাদ জানাবেন। আপনি নিজে যা চান না তা অন্যদেশের উপর চাপাবেন না


সমঝোতার সব রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলে লিন-সে-সু কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তৈরি হয়েছিলেন। ১৮৩৯ সালের ২৪শে মার্চ তিনি বেআইনি আফিং ব্যবসা বন্ধ করার জন্য ব্রিটিশ কুঠি বা ফ্যাক্টরিগুলিকে অবরোধ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রায় দেড় মাস বিদেশিদের ক্যান্টনে অবরুদ্ধ অবস্থায় রেখেছিলেন। বাধ্য হয়ে ইংরেজরা তাদের রাজপ্রতিনিধি ক্যাপ্টেন চার্লস এলিয়েটের হাতে তাদের সমস্ত আফিং জমা দিয়েছিল এবং সেগুলি লিনের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। বিশ হাজার পেটি বাজেয়াপ্ত আফিংকে দিন প্রকাশ্যে নষ্ট করেছিলেন। এই ঘটনায় ইংরেজ বণিকেরা ক্ষুব্ধ ও অপমানিত হয়েছিলেন এবং কীভাবে এই অপমানের প্রতিশোধ নেওয়া যায় তার প্রহর গুনেছিল। লিন-সে-সু ইংরেজ বণিকদের এই মর্মে এক চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করতে বলেছিলেন যে তারা ভবিষ্যতে চীনে আর আফিং আনবে না। কিন্তু ইংরেজ বণিকরা এই ধরনের চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেনি। এই ঘটনা ইঙ্গ-চীন সম্পর্ককে খারাপ করেছিল। লিন ইংরেজ বণিকদের কাছ থেকে তারা ভবিষ্যতে চীনে আরআফিং আমদানি করবে না এই প্রতিশ্রুতি আদায় করতে অক্ষম হয়ে তাদের ক্যান্টন ছেড়ে ম্যাকওয়েতে চলে যেতে বাধ্য করেছিলেন। এই ঘটনাও ইংরেজদের অপমানিত করেছিল। এইসব ঘটনাবলি থেকে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে লিন-সে-সু বিজয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তব অন্য কথা বলে। লিন-সে-সু ব্রিটিশ জাতির আত্মাভিমানে আঘাত করেছিলেন। একে মুখ বুজে সহ্য করার শিক্ষা তাদের অভিধানে ছিল না।

আফিং-এর যুদ্ধে লিন্-সে-সুর ভূমিকা | Lin-se-sur's role in the opium war


ইঙ্গ-চীন সম্পর্ক এই ঘটনার পর কোলুনে মদ বিক্রিকে কেন্দ্র করে আরও তিক্ত হয়েছিল। ১৮৩৯ সালের ৭ই জুলাই ইংরেজরা লিন-ওয়ে-সি নামে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করেছিল। ক্যান্টনের কমিশনার এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ইংরেজদের তাঁর হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু ইংরেজ প্রতিনিধি এলিয়ট নানা অজুহাতে বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। আসলে ইংরেজদের বক্তব্য ছিল ব্রিটিশ নাগরিকদের বিচার করার কোনো অধিকার চীনাদের নেই। দোষীদের বিচার এলিয়ট করবেন। তিনি বিচারের নামে প্রহসন করেছিলেন। ইংরেজদের যোগ্য জবাব দেওয়ার জন্য লিন তাদেরকে খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রি নিষিদ্ধ করেছিলেন। তিনি পার্তুগিজদেরকে ব্রিটিশদের ম্যাকাও থেকে তাড়াবার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। ১৮৩৯ সালের ২৬ আগস্ট ব্রিটিশরা ক্যান্টন থেকে হংকং-এ চলে গিয়েছিল। কমিশনার লিন-সে-সু ওই দিন বিজয়ীর মতো ক্যান্টন পরিভ্রমণ করেছিলেন। এইসময় পর্যন্ত ইংরেজদের সঙ্গে চীনাদের বিরোধের সকল স্তরে লিনের সাফল্য ছিল প্রশ্নাতীত। ইম্যানুয়েল শ্য-র ভাষায় : Upto this point Lin had won at every stage of the conflic


আফিং যুদ্ধ শুরু হওয়ার পিছনে লিন-সে-সুর ভূমিকাকে অস্বীকার করা যাবে না। লিন-সে-সুর ভূমিকা ইংরেজদের অসুবিধায় ফেলেছিল। বেআইনি আফিং আমদানি করে ইংরেজ বণিকেরা প্রচুর মুনাফা লাভ করেছিল। লিন-সে-সু তাদের অসাধু_ ব্যবসায় বাধা দিয়েছিলেন। সামরিকভাবে ইংরেজরা পিছু হটলেও বাস্তবে দেখা যায় লিনের ভূমিকা প্রথম ইঙ্গ-চীন যুদ্ধের ক্ষেত্রকে প্রস্তুত করেছিল। প্রথম ইঙ্গ-চীন যুদ্ধ বা আফিং-এর যুদ্ধে চীন পরাজিত হয়েছিল। নানকিং চুক্তি দ্বারা ইংরেজরা চীনের উপর চাপিয়ে দিয়েছিল তাদের অপমানের জবাব।

Post a Comment

0 Comments